শহীদ ১৩৩ শিশু

শহীদ
গত বছরের জুলাই মাসে বাংলাদেশজুড়ে ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলন দমনে চালানো সহিংস অভিযানে প্রাণ হারিয়েছে কমপক্ষে ১৩৩ শিশু। এদের অধিকাংশই স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থী পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের শ্রমে নিয়োজিত শিশুরাও রয়েছে। এমনকি নিজ বাসায় অবস্থান করেও গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছে অন্তত চার শিশু। সর্বকনিষ্ঠ শহীদ শিশু ছিল মাত্র চার বছরের আবদুল আহাদ। রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগে নিজের বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকাকালীন গুলিতে আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে ২০ জুলাই মৃত্যুবরণ করে সে। আহাদের মতো আরও তিন শিশু নিজ বাসায় অবস্থান করেই গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারায়। তারা হলো: সাফকাত সামির (১০), নাঈমা সুলতানা (১৫) ও রিয়া গোপ (৬)। এই চার শিশুই নিজেদের নিরাপদ মনে করা জায়গায় থেকেও গুলির শিকার হয়। অনুসন্ধান বলছে, ১৩৩ শহীদ শিশুর মধ্যে ৯১ জন পড়াশোনা করত বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে—এটি মোট প্রাণহানির ৬৮ শতাংশ। আর ৪১ জন শিশু বিভিন্ন অনানুষ্ঠানিক খাতে শ্রমে নিয়োজিত ছিল। প্রথম শহীদ শিশুর নাম মো. সিয়াম (১৫), যিনি ঢাকায় বেড়াতে এসে ১৭ জুলাই যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান। ৮৮ শতাংশ শিশুই গুলিবিদ্ধ এই গণ–অভ্যুত্থানে নিহত শিশুদের মধ্যে ১১৭ জনই সরাসরি গুলির শিকার হয়েছে, যা মোট নিহতদের ৮৮ শতাংশ। কেউ কেউ কাছ থেকে একাধিক গুলির শিকার হন, এমন ঘটনাও রয়েছে। নারায়ণগঞ্জের কলেজছাত্র ইমাম হাসান তায়িম (১৭)–কে পুলিশের একাধিক গুলিতে হত্যা করার একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়। শহীদ শিশুদের মধ্যে ছিল চারজন মেয়েশিশুও—রিয়া গোপ, নাঈমা সুলতানা, রিতা আক্তার এবং নাফিসা হোসেন মারওয়া। রিতা ও নাফিসা সরাসরি আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন, বাকিরা বাসায় থেকেই গুলিবিদ্ধ হন। নাঈমার মা আইনুন নাহার বলেন, "নিজের বাসায় এভাবে অনিরাপদ হয়ে পড়ব, ভাবিনি। নাঈমা চিকিৎসক হতে চেয়েছিল, সব শেষ হয়ে গেল।" সহিংসতা ও ‘গণহত্যার’ অভিযোগ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছাত্র-জনতার ওপর হামলা চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের (বর্তমানে নিষিদ্ধ) নেতাকর্মীরা। শিশুদের মৃত্যুর জন্য সরাসরি গুলির আদেশদাতা হিসেবে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম উঠে এসেছে একাধিক সূত্রে। শহীদ আস সাবুরের ভাই রিজওয়ানুল ইসলাম বলেন, “এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে থাকা ব্যক্তিদের বিচার চাই। এটা ছিল সুপরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ।” একই ধরনের মত দেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরীও। তিনি বলেন, “শিশু–কিশোরসহ নিরস্ত্র মানুষের ওপর হামলা চালিয়ে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, তা গণহত্যা ছাড়া আর কিছুই নয়।” শহীদদের তালিকা ও সরকারি হিসাব সরকারি গেজেট অনুযায়ী, ২ আগস্ট পর্যন্ত ৮৪৪ জন শহীদের তালিকা প্রকাশ করা হয়। তবে ৩ আগস্ট রাতে নতুন গেজেটে ৮ জনের নাম বাদ দিয়ে চূড়ান্ত তালিকায় ৮৩৬ জন শহীদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাদ পড়াদের মধ্যে এক শিশুসহ চারজনের নাম ছিল দ্বৈতভাবে। বাকি চারজন সরাসরি আন্দোলনে জড়িত ছিলেন না। শহীদদের মধ্যে অন্যতম শাহারিয়ার খান আনাস (১৬), যিনি আন্দোলনে যোগ দেওয়ার আগে বাড়িতে মাকে চিঠি লিখে গিয়েছিলেন: “মা, আমি মিছিলে যাচ্ছি। নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলাম না... গুলি খেয়ে বীরের মতো মৃত্যু অধিক শ্রেষ্ঠ।” তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থনে ‘হেলমেট বাহিনী’ সহিংসতায় অংশ নেয়, এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে একাধিক পরিবার থেকে। একজন শহীদ বাবার কণ্ঠে উঠে এসেছে অভিমান ও দাবি: “ছেলেকে ছাড়া কিছু ভালো লাগে না। যারা গুলি করেছে, তাদের বিচার চাই।” —আবুল হাসান, শহীদ আহাদের বাবা। আমারবাঙলা/এফএইচ

Join Telegram

Post a Comment

Previous Post Next Post